নিশ্চিত ক্ষমার চেয়ে তুচ্ছ টাকার কি তুলনা হতে পারে?

এক অসহায় ব্যক্তি। খুবই গরীব। স্ত্রী পুত্র নিয়ে বহু কষ্টে সংসার চলে তার। মাঝে মধ্যে সে না খেয়ে থাকে। তবু একান্ত ঠেকা না হলে মানুষের কাছে হাত পাতে না। গ্রহণ করে না ধার করজও। একদিন লােকটি ভীষণ সমস্যায় পড়ল। এমন সমস্যায় কখনাে সে পড়েনি। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সমস্যার কথা জানিয়ে এক ব্যক্তির কাছ থেকে সে সাতশত টাকা কর্জ গ্রহণ করল। লােকটি গরীব হলেও অত্যন্ত সৎ ছিল। জীবন দিয়ে হলেও সে ওয়াদা রক্ষা করার চেষ্টা করত। এ ব্যাপারে কখনােই সে অলসতা করত না। করজদাতার কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে টাকা পরিশােধের কথা উল্লেখ করে সে করয গ্রহণ করেছিল। বলেছিল, আমি যে কোনাে উপায়ে নির্ধারিত সময়ে করজ পরিশােধ করবই ইনশাআল্লাহ।
নিশ্চিত ক্ষমার চেয়ে তুচ্ছ টাকার কি তুলনা হতে পারে?

সময় তার আপন গতিতে চলতে থাকে। একদিন দুদিন করে সময় বয়ে যায়। এভাবে খুবই নিকটে চলে আসে করজ পরিশােধ করার নির্দিষ্ট তারিখটি। কিন্তু এ পর্যন্ত সে অনেক চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারেনি। পারেনি একটি টাকাও সংগ্রহ করতে। আর পারবেই বা কি করে? তার উপার্জিত অর্থ দিয়ে তাে সংসারের নূন্যতম প্রয়ােজন মেটাতেই তাকে হিমশিম খেতে হয়েছে। এজন্য ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায় সে। অবশেষে কোনাে উপায় না দেখে লােকটি বিশিষ্ট বুযুর্গ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহ.-এর নিকট গেল। ঋণের ব্যাপারে সবকিছু খুলে বর্ণনা করে শেষ পর্যায়ে বলল, হযরত! এ ঋণ পরিশােধ করার মত ক্ষমতা আমার নেই। সুতরাং এখন আমি কি করতে পারি এ ব্যাপারে পরামর্শ দিলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। 

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহ, ছিলেন উদার মনের মানুষ। লােকটির এ অসহায়ত্বের কথা শুনে তার কামল হৃদয় ব্যথায় ভারাক্রান্ত হলো। চোখ হতে টপটপ করে ঝরে পড়ল বেদনার নীল অশ্রুমালা। ভাবলেন তিনি, আমি স্বাচ্ছন্দের সাথে সুখে দিনাতিপাত করব, আর আমারই আরেক ভাই টাকার অভাবে পেরেশানী উঠাবেন, কষ্ট ভােগ করবেন, এটা কখনাে হতে পারে না।

তাই সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজ কোষাগারের দায়ত্বশীল বরাবর সেই নিঃস্ব ব্যক্তির অবস্থার কথা উল্লেখ করে একটি পত্র লিখলেন। তারপর উহা লােকটির হাতে দিয়ে বললেন, এ চিঠিটা আমার কোষাগারের দায়িত্বশীলের কাছে নিয়ে যাও। আশা করি এতে তােমার প্রয়ােজন পূর্ণ হবে। লােকটি চিঠি নিয়ে এগিয়ে চলল। মনে মনে ভাবতে লাগল, হযরত যখন আমার প্রয়ােজন পূর্ণ হওয়ার কথা বলেছেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি সাতশত টাকার কম লিখেননি। তখনকার দিনে সাতশত টাকা কোনা চাট্টিখানি কথা নয়। 
 
অকল্পনীয় এ অনুদানে লােকটি আনন্দে বিহবল হয়ে গেল। এক টুকরা মধুর হাসি ফুটে উঠল তার ঠোটের কোণে। অধীর আগ্রহে সে হযরত ইবনে মুবারক রাহ.- এর কোষাগারের দায়িত্বশীলের কাছে গেল এবং তার হাতে চিঠিখানা দিয়েই আনন্দ গদগদ কণ্ঠে বলতে লাগল, আমি সাতশত টাকা ঝণগ্রস্থ। করজদাতা দুদিন পর এসেই আমাকে টাকার জন্য চাপ দিবে। কিন্তু সে টাকা পরিশােধ করার মত সামর্থ আমার নেই। উপায় না দেখে আমি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহ. কে বিষয়টি জানালাম। আল্লাহ তাআলা হযরতকে রহম করুন। তিনি আমার পুরাে করজটাই আদায় করার দায়িত্ব নিয়েছেন। আমার সাতশত টাকা করজ আদায়ের জন্য আপনার কাছে এ পত্র দিয়েছেন।

পত্রের বক্তব্যের সাথে লােকটির কথার মিল না হওয়ায় কোষাগারের ম্যানাজার তার দিকে সবিস্ময়ে তাকালেন। বললেন, তােমার যিম্মায় কত টাকা করজ আছে? সে উত্তরে সাতশত টাকার কথাই বলল। সেই সঙ্গে আবারাে বলল, পূর্ণ টাকা দেওয়ার আশা দিয়েই হযরত আমাকে আপনার কাছে পত্র দিয়ে পাঠিয়েছেন।

ম্যানাজার আগেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিল। এবার দ্বিধার পরিমান আরাে বৃদ্ধি পেল। কেননা লােকটি বলছে সাতশত আর চিঠিতে লেখা আছে। সাত হাজারের কথা। তাই সে লােকটিকে সম্বোেধন করে বলল, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি হযরতের সাথে একটু আলাপ করে নেই। অপেক্ষার সময়টুকু পার করার জন্য লােকটি পাশের রুমে গেল। সেখানে বসার সুন্দর জায়গা আছে। কিন্তু তার আর বসা হলা না। সে অস্থিরভাবে গােটা কক্ষে পায়চারি করতে লাগল। মুখমন্ডলে তার গভীর উদ্বিগ্রতা ফুটে উঠেছে। ভাবছে সে, তবে কি হযরত চিঠিতে টাকার পরিমান কিছু কম লিখেছেন? হয়তাে বা তাই হবে। নইলে ম্যানাজার এমন করবেন কেন?

লােকটিকে অপেক্ষা করতে বলে ম্যানাজার সাথে সাথে কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসলেন। লিখলেন, হযরত! সে ব্যক্তির তাে সাতশত টাকা করজ। সাতশত টাকার কথাই সে বারবার বলছে। আর চিঠিতে লিখা আছে সাত হাজারের কথা। তাই এখন আমি কি করব বলে দিলে খুশি হব। হযরত আবদুল্লাহ হবনে মুবারক রাহ. পত্র পাওয়া মাত্র বিলম্ব না করে ম্যানাজারের কাছে পুনরায় পত্র লিখলেন। বললেন, এখন তাকে চৌদ্দ হাজার টাকা দিয়ে দাও। 

ম্যানাজার কিছুটা বিস্মিত হয়ে আবার পত্র লিখল। তাতে লেখা ছিল, হুজুর! এভাবে অনুদান দিতে থাকলে তাে অল্প সময়ে ধন ভান্ডার ফুরিয়ে যাবে। সামনে এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ভাল হবে। ম্যানাজারের এ পত্র পেয়ে হযরত ইবনে মুবারক রাহ. গভীর মর্মপীড়া অনুভব করেন। ফোঁটা ফোটা ঘাম ফুটে উঠে তার শুভ্র ললাটে। ভােরের শিশির বিন্দুর মতই চকচক করছিল সে ফোটাগুলাে। তিনি আবার ম্যানাজারের কাছে এ কথা লিখে পত্র পাঠালেন যে, অনতিবিলম্বে তুমি তাকে চৌদ্দ হাজার টাকা দিয়ে দাও। আমি তাে দুনিয়াকে নিঃশেষ করে আখেরাত গােছানাের চিন্তাভাবনা করছি। তুমি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই পবিত্র বাণী কখনাে শোননি যে, তিনি ইরশাদ করেছেন- কোনাে মুসলমানের প্রয়ােজনে যখন অপর কোনাে মুসলমান ভাই তার আশাতীত সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে, তখন আল্লাহ পাক সাহায্যকারীকে ক্ষমা করে দেন।

এবার তুমিই বলা, এই নিশ্চিত ক্ষমার ঘােষণার সাথে তুচ্ছ চৌদ্দ হাজার টাকার কি তুলনা হতে পারে?

প্রিয় পাঠকবৃন্দ! শিক্ষণীয় এ ঘটনাটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে সহজেই বুঝে আসবে যে, আমাদের পূর্বসুরি বুযুর্গগণ দুনিয়াকে কত তুচ্ছ নজরে দেখেছেন। অথচ আজ আমরা সামান্য এই দুনিয়ার পিছনে পড়ে
আমাদের পরকালকে বরবাদ করে দিচ্ছি অবলীলায়। হালাল হারামের বাছ বিচার না করে টাকার পাহাড় গড়ে তুলছি । একবারও চিন্তা করে দেখছি না যে, এই টাকা আমার আখেরাতর জীবনে কতটুকু কাজে আসবে। 

হে আল্লাহ! আমাদের উপার্জিত টাকা পয়সা ও সহায় সম্পত্তি যেন আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহে সাহায্যকারী হয় সেরূপ ব্যবস্থা তুমি করে দাও। আমীন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ