গত কয়েক মাস আগের ঘটনা। বিশেষ প্রয়ােজনে বাড়ি গিয়েছিলাম। ব্যস্ততা ছিল প্রচুর। দম ফেলবার অবসর নেই। এরই মধ্যে এক লােক এসে হাজির। লােকটি আমার আত্মীয়। দূরের নয়, একেবারে কাছের। যাকে বলে নিকটাত্মীয়। এসেই মিনতিভরা আবদার- তােমাকে আগামীকাল এক জায়গায় যেতে হবে। কোথায় যেতে হবে? আমার পাল্টা প্রশ্ন। খুব বেশি দূরে নয়। এই তাে শহরের এক জায়গায়।
- আমি তাে ভীষণ ব্যস্ত। হাতে অনেক কাজ। দু' দিনের জন্য বাড়িতে এসেছি। এর মধ্যে কাজগুলাে শেষ করতে পারব কি-না, সে চিন্তাই করছি।
- অতসব আমি বুঝি না। যেতে তােমাকে হবেই। আমি তােমার অপেক্ষায় ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, তুমি আসলে খুব ভাল হত। আল্লাহ আমার আশা পুরা করেছেন। - তা কাজটা কি একটু শুনি।
কঠিন কোনাে কাজ নয়। আমার ছেলের বিয়ের ব্যাপারে আলাপ-আলােচনা চলছে। আগামীকাল কয়েকজন লােক মেয়ের বাড়ি দেখতে যাবে। জুমআর নামাজ শহরের মধ্যপাড়া মসজিদে পড়ার কথা মসজিদের পাশেই মেয়েদের বাড়ি। মাত্র দু' মিনিটের পথ।
- লােকজন মেয়ের বাড়ি দেখতে যাবে, মেয়ে দেখবে না?
- সেটা কি আর বলতে হয়!
আমি এসব কাজে খুব একটা যাই না। যাওয়ার সময়ও হয় না। তবে আপনি যখন এসেছেন, আপনার সম্মানাথে শত কাজ থাকা সত্ত্বেও যাওয়ার এরাদা করছি। অবশ্য আমার একটা শর্ত আছে। সে শর্তটি পালন হওয়ার ব্যাপারে আপনার পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা পেলেই আবেদন রক্ষা করা সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ। অন্যথায় নয়।
- বলাে, তােমার কী শর্ত আছে। তামার যে কোনাে শর্ত মানতে রাযি। শর্তটি হলাে, সেখানে কোনাে শরিয়ত বিরােধী কাজ হতে পারবে না। ছেলে কেবল একাই মেয়ে দেখবে। আমরা যারা এখান থেকে যাব, তাদের কেউ দেখতে পারবে না।
- ছেলের পিতা ও বন্ধু-বান্ধবরাও দেখতে পারবে না?!
- না, কেউ দেখতে পারবে না। যদি এই শর্ত মানতে রাযি থাকেন তবেই আমি যেতে প্রস্তুত আছি। অন্যথায় আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে মাফ করবেন। ঠিক আছে। তােমার শর্ত অবশ্যই মানা হবে। তবে আমার একটি প্রশ্ন। করুন। নির্দ্িধায়। নিঃসঙ্কোচে।
- আমার প্রশ্ন হলাে, ছেলে একা দেখে কি মেয়ের ভাল মন্দ পুরােপুরি বুঝতে পারবে? যাচাই করতে পারবে তার জ্ঞানবুদ্ধি, গুণাবলী?
- ছেলের একা দেখা যথেষ্ট মনে না করলে প্রয়ােজনে মহিলারা দেখতে পারে। তারা মেয়ের সাথে বিভিন্ন প্রকার কথাবার্তা বলে তার বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি যাচাই করতে পারে। তাছাড়া মহিলাদের দেখায় কিছু বাড়তি ফায়দাও আছে। যা হাসিল করা পুরুষদের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা মহিলারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেয়ে দেখতে পারে, বিভিন্ন ব্যাপারে প্রশ্ন করে এমন কিছু জেনে নিতে পারে যা পুরুষদের পক্ষে জানা বা দেখা কখনােই সম্ভব নয়। . হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। কয়েকদিন আগে আমি নিজে মেয়ে দেখে এসেছি। অনেকক্ষণ তাদের বাড়িতে ছিলাম। মেয়ের কাজকর্ম, চলাফেরা, আচার-আচরণ ইত্যাদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। দৈহিক ও মানসিক অবস্থাও তীক্ষ্ম দষ্টিতে দেখতে ভুল করি নি। আমার বিশ্বাস, পুরুষরা তা কখনােই পারবে না। পারার কথাও নয়। যাক, তােমার যাওয়ার ব্যাপারে আমি নিশ্ষিত হলাম। আমি এখনই গিয়ে পুরুষদের বলে দিচ্ছি, তারা যেন নিজেরা মেয়ে না দেখে।
পরদিন। যথাসময়ে উপস্থিত হলাম মেয়ের বাড়িতে। আমাদের লােকসংখ্যা আরট দশজনের কম হবে না। প্রথমে আদর আপ্যায়ন চলল। মেয়ের বাপ এবং বেশ কিছু আত্ময়স্বজন তখন উপস্থিত ছিলেন। তাদের ব্যবহার ও আচার আচরণে বুঝা গেল, গভীর আন্তরিকতার সহিতই তারা আমাদের গ্রহণ করেছেন। খাওয়া দাওয়ার পর আলাপ আলোেচনা শুরু হলাে। নতুন করে জানা হলাে, মেয়ে সমন্ধে বহু তথ্য। সেই সঙ্গে জানা হলাে, মেয়ের বাড়ির নানান বিষয়। এক কথায়, বিয়ের সময় সাধারণত যা জানার প্রয়ােজন বােধ করা হয়, তার কোনােটাই আলােচনা থেকে বাদ যায়নি। আলােচনায় আমিও যােগ দিয়েছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, মেয়ে ও মেয়ে পরিবারের দীনদারীর পরিমান সম্পর্কে অবগতি লাভ করা। খােদা তাআলার অপরিসীম ফজল ও করম যে, অল্প সময়ের মধ্যেই আমি আমার উদ্দেশ্য হাসিল করতে সমর্থ হয়েছি। কথাবার্তা শেষ হলাে। মেয়ে দেখানার পালা এলাে। মেয়ে কেবল ছেলেই দেখবে- এ তাে আমার আগেরই কথা। শর্ত করেই এসেছি আমি।
তবুও শরীয়তের বিধানটি আবার তাদের জানিয়ে দিলাম। স্মরণ করিয়ে আমার কথায় তারা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তবে আমাকে সবাই অত্যধিক স্নেহ করেন বলে মুখ খুলে আবার কিছু বলতেও পারছে না। ভাবখানা এমন, মেয়ের বাড়িতে এসে ছেলেই কেবল মেয়ে দেখে চলে যাবে, অন্য কেউ দেখবে না, এ কেমন কথা! ফিসফিস করে গুঞ্জরণ শুরু হলাে। দু' চার জন বাইরে গিয়ে পরামর্শ করল। সিদ্ধান্ত হলাে, মেয়ে তারা সবাই মিলেই দেখবে। আর আমাকে দু তিনজন মুরব্বীসহ অন্য ঘরে পাঠিয়ে দেবে। মুরব্বীরা আমার সাথে কথাবার্তা বলবে। বাড়িঘর কেমন লাগল, এখানে আত্মীয়তা করা যায় কি না ইত্যাদি বিষয়ে আলােচনা করে সময় কাটাবে। আর এই ফাকে তার নির্বিঘ্নে সমাধা করবে বউ দেখার কাজটি আমি সরল মানুষ। এতসব প্যাচপোচ বুঝি না। বুঝার চেষ্টাও করিনা।
সিদ্ধান্ত মােতাবেক আমাকে অন্য রুমে সরিয়ে নেওয়া হলাে। কথাবার্তা চলল অনেকক্ষণ ধরে। আর এই সুযােগে শুরু হলাে বউ প্রদর্শনী। কিছুক্ষণ পর মেয়েলি কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত শুনে চমকে এরপর ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম সবকিছু। ব্যথায় চিনচিন করে উঠল বুকটা। ভাবলাম, হায়! আমাদের ঈমান-আমল কি এতই নিচে চলে গেল যে, শরয়ী বিধান জানানাের পরও তা মানার জন্য তৈরি হতে পারি না? মনের গহীনে কি একটু ভয়ও জাগে না যে, এর শাস্তি অবশ্যই একদিন ভােগ উঠলাম করতে হবে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে আমার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। ভীষণ কষ্ট পেলাম আমি। তবে কাউকে তা বুঝতে দিলাম না মােটেও।
একটু পর কারাে ডাকে বাইরে গেলাম। আমাদের প্রায় সবাই জড়াে হয়েছে সেখানে। মেয়ে-পক্ষ থেকে কী বলে বিদায় নেওয়া যায়, এবারের আলােচ্য বিষয় ছিল এটিই। প্রত্যেকেই যার যার মত পেশ করছে। এমন সময় কেউ বলে উঠল, ছেলেকেও ডেকে তার মতামত জিজ্ঞেস করা হােক। একজন চলে গেল ছেলে আনতে। এরপর অনেকক্ষণ অতিবাহিত হলাে। কিন্তু ফিরে আসার কোনাে নাম গন্ধ নেই। ছেলেকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এক সময় তাকে ঘরের অন্য একটি রুম থেকে বের হতে দেখা গেল। জিজ্ঞেস করা হলাে, এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি? ছেলে জবাব দিল, আপনারা চলে আসার পর আমাকে একটি মহিলা বলল, একটু ভেতরে আসুন। আমি ভেতরে গেলাম। দেখলাম, ঐখানে শুধু মেয়ে আর মেয়ে। বউ বসা ছিল একটি খাটের উপর।
এমতাবস্থায় কি করব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় আরেকজন মহিলা এসে আমার হাত ধরে আমাকে একেবারে বউয়ের গা ঘেরষে বসাল। তারপর আমাকে এক গ্লাস দুধ খেতে দিয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না। একটু পরিচিত হতে ভিতরে নিয়ে এলাম। এই বলে তিনি এক এক করে উপস্থিত সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ঐ সময় তাে অন্যান্য প্রাণভরে কথা বলুন। আমরা গেলাম। বউকে রেখে সত্যিই সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এমন একটা পরিস্থিতির জন্য মােটেই প্রস্তুত ছিলাম না আমি। বড়ই অস্বস্তি লাগছিল। আমার তাই শেষমেষ কোনাে কিছু না বুঝে লজ্জার মাথা খেয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। ছেলের মুখ থেকে এসব কথা শুনে মনটা আরাে খারাপ হয়ে গেল । তাই সাথে সাথে নিয়ত করলাম, যদি আল্লাহ পাক তাওফীক দেন তবে পাত্রী দেখা প্রসঙ্গে কিছু জরুরি কথা লিখব।
এতক্ষণ যা লিখেছি এবং সামনে যা লিখতে যাচ্ছি, এর সবকিছু মূলত ঐদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই। মুহতারাম পাঠক-পাঠিকা! এখন আমি মূল কথা শুরু করার আগে ভূমিকা স্বরূপ দু চারটি কথা বলতে চাই। যাতে সামনের কথাগুলাে আপনারা ভাল করে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের বিধানাবলি সহজ, সাবলীল, সুন্দর, উৎকৃষ্ট এবং কল্যাণকর। একথা ঠিক যে, প্রবৃত্তির অনুসরণ করার কোনাে সুযােগ ইসলামে নেই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ইসলাম মানুষকে তার প্রয়ােজনীয় চাহিদা বা তার মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের কোনাে সুযােগ দেয় না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের বিধানাবলিকে সঠিক, সহজ ও সাবলীল অবস্থানে রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। কঠিন ও জটিল করতে নিষেধ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন-
নশ্চয়ই দীন সহজ। দীন পালনে যে কঠোরপন্থা অবলম্বন করবে, দীন তার জন্য সাধ্যাতীত হয়ে পড়বে। অতএব তােমরা সঠিক পথ অবলম্বন করাে এবং সহজ পথে অগ্রসর হও। (বুখারী১/১০)
কতিপয় সাহাবী যখন দীনকে কঠিনভাবে পালন করার ইচ্ছা করলেন এবং বললেন যে, আমি তাদের একজন বললেন যে, আমি সারা রাত ইবাদত করব, নিদ্রা যাব না। আরেকজন বললেন, আমি বিরতিহীনভাবে রােজা রাখব, কখনাে রােজা ছাড়ব না। অন্যজন বললেন, আমি ঝামেলামু্ত থেকে ইবাদত বন্দেগীতে মগ্ন থাকার জন্য বিয়েই করব না। তাদের এ পরিকল্পনার খবর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছলে, তিনি তাদেরকে ডেকে বললেন, জেনে রেখাে, কসম খােদার-আমি তােমাদের চেয়ে বেশি পরহেজগার এবং আল্লাহকে তােমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি। কিন্তু আমি রােজা রাখি এবং ছেড়ে দেই। নামাজ পড়ি এবং নিদ্রা যাই। আবার বিয়ে-শাদীও করি। সুতরাং যে আমার নীতির বিরােধিতা করবে , সে আমার উম্মত নয়।
(বুখারী, মুসলিম, মেশকাত১/২৭)
এভাবে নবী করীম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বিধানাবলিকে তার সঠিক, সরল ও সাবলীল স্থানে রেখে পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। নিষেধ করেছেন কঠিন ও জটিল করতে। কিন্তু মাঝে মধ্যে আমাদের ভুলের কারণে, ইসলামী বিধানের বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট হয়ে থাকে। আমরা কোনাে কোনাে ব্যাপারে ইসলামের সঠিক বিধানটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে সেখানে জটিল কিছু গ্রহণ করে বসি অথবা ইসলামী বিধানের সঠির প্রয়ােগ পদ্ধতি গ্রহণ না করে ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করে, ইসলামী বিধানের সৌন্দর্য ও সাবলীলতা নষ্ট করে ফেলি।
0 মন্তব্যসমূহ