আজ থেকে বহুকাল পূর্বের কথা। তখন ইরানের বাদশাহ ছিলেন শাহ আব্বাস। ন্যায়পরায়ণ ও সুশাসক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। তার অভ্যাস ছিল আমীরুল মুমেনীন হযরত ওমর রা. এর মতই । তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ছদ্মবেশ ধারণ করে বেরিয়ে যেতেন এবং রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সাধারণ প্রজাদের খোঁজ-খবর নিতেন।
একদিনের ঘটনা, বাদশাহ আব্বাস অনেক পথ হেটে শহর ছেড়ে শহরতলী এসে পৌঁছলেন। হঠাৎ তাঁর নযরে একটি কুড়েঘর পড়ল। সেদিন তিনি দরবেশের ছদ্মবেশে বেরিয়েছিলেন। এক পা দু পা করে কুড়েঘরের সামনে এসে তিনি ঘরের মালিকের কাছে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। ঘরের মালিক বেরিয়ে এসে তাঁকে সালাম দিলেন। তারপর অত্যন্ত তাজিমের সাথে ভিতরে নিয়ে একটি ছেঁড়া মাদুরে বসতে দিলেন।
বাদশাহ লােকটির সাথে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললেন। কথার ফাঁকে লােকটি কোথায় কি করে জেনে নিলেন। সেই সঙ্গে এও বুঝে নিলেন যে, লােকটি গরিব হলেও বেশ মিশুক ও রসিকপ্রিয়। লােকটি ছিল চর্মকার। সারাদিন জুতো সেলাই করে যা পায় তা দিয়েই সুন্দর করে সংসার চলে যায়। তার সাথে আলাপ করে বাদশাহ দারুণ খুশি হলেন। তদুপরি তার অতিথিপরায়নতা বাদশাহকে আরাে মুগ্ধ করল। এক পর্যায়ে লােকটি জানাল, গােটা দিন সে যা রুজি করে ঐদিনই তা খরচ বাদশাহ জানতে চাইলেন,আপনি তা দিনের আয় দিনেই শেষ করে ফেলেন। তবে কি পরদিন তথা ভবিষ্যতের জন্য কিছুই জমা করে রাখেন না? লােকটি বললেন, না হুজুর। যা পাই তা এক সন্ধ্যাতেই খেয়ে সাবাড় করে ফেলি। কারণ আমি জানি, আল্লাহ আমার সৃষ্টিকর্তা। রিফিক দেওয়ার মালিক একমাত্র তিনিই। তার উপর আমার এ আস্থা আছে যে, তিনি আমাকে না খাইয়ে রাখবেন না।
আল্লাহর প্রতি লােকটির অবিচল আস্থা দেখে বাদশাহ খুশি হলেন। তবে তার আস্থা কতটুকু মজবুত তা পরীক্ষা করার জন্য যাওয়ার সময় বলে গেলেন, আমি আগামীকাল আবার আসব। পরদিনই বাদশাহ ফরমান জারী করে দিলেন যে, বাদশাহের অনুমতি ছাড়া কেউ জুতাে সেলাই করতে পারবে না এবং ঐদিনই সন্ধ্যায় তিনি চর্মকারের বাড়িতে গিয়ে আবার হাজির হলেন। আজও তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, খাবার আর পানীয়ের কোনাে অভাব নেই। গতকালের চাইতে আজকের আপ্যায়ন আরাে ভাল হলাে।
বাদশাহ জিজ্ঞেস করলেন,
আজকে রুজি-রােজগার কেমন হলাে?
চর্মকার বললেন, রােজি -রােজগার ভালই হয়েছে হুজুর। সকালে কাজে গিয়ে শুনি, বাদশাহের অনুমতি ছাড়া জুতাে সেলাই করা যাবে না। তখন কি আর করব বলুন। গেলাম কাপড়ের হাটে। কাপড়ের মােঠ বহন করে বেশ ভালই আয় হয়েছে হুজুর।
বাদশাহ বললেন, ধরাে বাদশাহ যদি কুলির কাজ বন্ধ করে দেন, তাহলে কি করবে তুমি?
চর্মকার বললেন, কি করব জানি না। তবে রিজিকের মালিক আল্লাহ। তিনিই দেখবেন।
পরদিন সকালে বাদশাহ পুনরায় ফরমান জারী করলেন, বাদশাহের অনুমতি ছাড়া কেউ কুলির কাজ করতে পারবে না। এ ফরমান জারী করার পর সেদিন সন্ধ্যায় আবারাে বাদশাহ ছদ্মবেশ ধারণ করে চর্মকারের কুড়েঁঘরে এসে হাজির হলেন। দেখলেন, এদিনও তার খাবারের কোনাে অভাব হয়নি। তবু তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আজ কেমন কাটল তােমার? চর্মকার বললেন, কাজে বেরিয়ে শুনি, বাদশাহের অনুমতি ছাড়া কুলির কাজ করা যাবে না।
এ সংবাদ শুনে আমি একটু হাসলাম। মনে মনে বললাম, মহান আল্লাহর উপর যার আস্থা আছে, যার কাজ করার ইচ্ছা আছে, তার কি কাজের কোনাে অভাব হয়? সত্যিই আমার কাজের অভাব হয়নি। একটু ঘােরাঘুরি করতেই লাকড়ি চিরার কাজ পেয়ে গেলাম। মজরিও বেশ ভালাে পেয়ােছি। বাদশাহ বললেন, আচ্ছা ধরাে, আগামীকাল শুনলে, বাদশাহ লাকাড় চিরার কাজও বন্ধ করে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় কি করবে তুমি? চলব। এ নিয়ে চিন্তার কি আছে। বাদশাহ আর কথা বাড়ালেন না। তিনি শেষ বারের মত পরীক্ষা নেওয়ার এরাদা করে বিদায় নিয়ে চলে এলেন।
পরদিন বাদশাহের ফরমান জারী হলাে, বাদশাহের হুকুম ছাড়া কেউ লাকড়ি চিরার কাজ করতে পারবে না। এদিকে চর্মকার যথাসময়ে কাজের উদ্দেশ্যে বের হলেন। কিন্তু কোনাে কাজ না পেয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাদশাহের বাড়ি গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে একটু তদবীর করতেই রাজ-প্রহরীর চাকরীটা হয়ে গেল। তাকে দায়িত্ব পালনের জন্য একটি তরবারি দেওয়া হলাে। সারাদিন কাজ শেষে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফেরার পথে তিনি তরবারিখানা একটি দোকানে বিক্রি করে যা পেলেন, তাই দিয়ে খাবার কিনলেন।
বাড়ি ফিরে একটি কাঠের তরবারি তৈরি করে তা খাপে রেখে দিলেন।
ঐদিন রাতে বাদশাহ পূর্বের ন্যায় তার ঘরে তাশরীফ আনলেন। প্রতিদিনের মতই তিনি বাদশাহকে ভাল খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। খাওয়া দাওয়ার পর বাদশাহ তার আয় রােজগারের খবর নিলেন। চর্মকার জানালেন, আজও আমার আয় রােজগার খারাপ হয়নি। সকালে কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে কোনাে কাজ না পেয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে বাদশাহের বাড়ি গিয়েছিলাম সেখানে গিয়ে চৌকিদারের দায়িত্ব পেয়ে পেলাম। সেই সাথে একখানা সুন্দর তরবারিও পেলাম।
তবে দুখের বিষয় হলে৷, সারাদিন দায়িত্ব পালন করার পরও তারা আমাকে কোনাে পয়সা দিল না। তাই তরবারি বিক্রি করে আজকের খাবারের যােগাড় করেছি। আর আগামীকালের দায়িত্ব পালনের জন্য একটি কাঠের তরবারি তৈরি করে তা খাপে ভরে রেখেছি এবং নিয়ত করেছি, বেতন পেলে ঐ টাকা দিয়ে সর্বপ্রথম রাজবাড়ি থেকে দেওয়া তরবারির ন্যায় একখানা তরবারি বানিয়ে নিব বাদশাহ বললেন, আগামীকাল যদি রাজ কর্মচারীরা তাদের দেওয়া তরবারি দেখতে চায়, তাহলে কি করবে তুমি?
তিনি বললেন, আল্লাহ ভরসা। তখন যা করার তিনিই করবেন। পরদিন ভােরে চর্মকার বাদশাহের বাডি পাহারা দিতে গেলেন। তখন বাদশাহের শিখানাে কথা অনুযায়ী কোতােয়াল তার হাতে এক কয়েদিকে তলে দিয়ে বলল, একে অপরাধের শাস্তি হিসেবে মত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আর তরবারির প্রচণ্ড আঘাতে গ্দন উড়িয়ে দিয়ে মত্যদণ্ড কার্যকর করার ভার তােমাকেই দেওয়া হয়েছে। চর্মকার সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, মাফ করবেন হুজুর। আমি মানুষের গর্দান নিতে পারব না। কোতােয়াল বললেন, তােমাকে পারতই হবে। এটা স্বয়ং বাদশাহের নির্দেশ।
এবার চর্মকার বিপদে পড়লেন। তিনি আল্লাহর দিকে মনােনিবেশ করলেন। মনে মনে দোয়া করে বললেন, ওগাে মাওলা! আমার হাতে কোনাে মানুষ মারা সম্ভব নয়। তুম আমাকে নিজ কুদরতে এ বিপদ থেকে দোয়া শেষ হতে না হতেই আল্লাহ পাক তার মনে একটি সুন্দর কৌশল ঢেলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তরবারির খাপখানা উপরে তুলে ধরে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, আমি আল্লাহর নাম নিয়ে শপথ করে বলছি, যদি এই ব্যক্তি সত্যিই অপরাধী হয়ে থাকে, তবে এই খাপে ভরা তরবারি তার গর্দান নিবে। আর যদি সে অপরাধী না হয়, তবে আমার এই তরবারি কাঠের তার হাতে একখানা কাঠের তরবারি।
এ দৃশ্য দেখে কোতােয়াল সবকিছু বুঝলেও উপস্থিত লােকজন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। এদিকে বাদশাহ খবর শােনার জন্য অধির অপেক্ষায় ছিলেন। কোতােয়াল যথাসময়ে সবকিছু বাদশাহকে খুলে বলল। এতে তিনি দারুণ খুশি হয়ে চর্মকারকে ডেকে পাঠালেন। চর্মকার রাজ দরবারে হাজির হলে নিজের পরিচয় দিয়ে বাদশাহ তার সাথে মােয়ানাকা করলেন। সেই সঙ্গে রাজ পরিষদের লােকদের কাছে আল্লাহর উপর তার অবিচল আস্থা ও উপস্থিত বুদ্ধির ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তারপর তাকে শাহী দরবারে একটি উচ্চপদ দিয়ে বরণ করে নিলেন।
(সহায়তায়- সােনালী বিশ্বাস,পৃষ্ঠা-৩৪)
0 মন্তব্যসমূহ